হযরত ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) জিবনী-২

 হযরত ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) জিবনী-২ 



সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত কর’(৮৩)। ‘এবং আমাকে পরবর্তীদের মধ্যে সত্যভাষী কর’ (৮৪)। ‘তুমি আমাকে নে‘মতপূর্ণ জান্নাতের উত্তরাধিকারীদের অন্তর্ভুক্ত কর’(৮৫)। (হে প্রভু) ‘তুমি আমার পিতাকে ক্ষমা কর। তিনি তো পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভুক্ত’(৮৬) (হে আল্লাহ) ‘পুনরুত্থান দিবসে তুমি আমাকে লাঞ্ছিত কর না’ (৮৭)। ‘যে দিনে ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কোন কাজে আসবে না’ (৮৮) ‘কিন্তু যে ব্যক্তি সরল হৃদয় নিয়ে আল্লাহর কাছে আসবে’ (৮৯)। ‘(ঐ দিন) জান্নাত আল্লাহভীরুদের নিকটবর্তী করা হবে’(৯০)। ‘এবং জাহান্নাম বিপথগামীদের সামনে উন্মোচিত করা হবে’(৯১)। ‘(ঐ দিন) তাদেরকে বলা হবে, তারা কোথায় যাদেরকে তোমরা পূজা করতে’?(৯২) ‘আল্লাহর পরিবর্তে। তারা কি (আজ) তোমাদের সাহায্য করতে পারে কিংবা তারা কি কোনরূপ প্রতিশোধ নিতে পারে’? (৯৩)। ‘অতঃপর তাদেরকে এবং (তাদের মাধ্যমে) পথভ্রষ্টদেরকে অধোমুখী করে নিক্ষেপ করা হবে জাহান্নামে’(৯৪) ‘এবং ইবলীস বাহিনীর সকলকে’ (৯৫)। ‘তারা সেখানে ঝগড়ায় লিপ্ত হয়ে বলবে’(৯৬) ‘আল্লাহর কসম! আমরা প্রকাশ্য ভ্রান্তিতে ছিলাম’(৯৭), ‘যখন আমরা তোমাদেরকে (অর্থাৎ কথিত উপাস্যদেরকে) বিশ্বপালকের সমতুল্য গণ্য করতাম’(৯৮)।‘আসলে আমাদেরকে পাপাচারীরাই পথভ্রষ্ট করেছিল’ (৯৯)। ‘ফলে (আজ) আমাদের কোন সুফারিশকারী নেই’ (১০০) ‘এবং কোন সহৃদয় বন্ধুও নেই’(১০১)। ‘হায়! যদি কোনরূপে আমরা পৃথিবীতে ফিরে যাবার সুযোগ পেতাম, তাহ’লে আমরা ঈমানদারগণের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতাম’(১০২)। ‘নিশ্চয়ই এ ঘটনার মধ্যে নিদর্শন রয়েছে। বস্ত্ততঃ তাদের অধিকাংশই বিশ্বাসী ছিল না’ (১০৩)। ‘নিশ্চয়ই আপনার পালনকর্তা পরাক্রান্ত ও দয়ালু’ (শো‘আরা ২৬/৬৯-১০৪)।


স্বীয় পিতা ও সম্প্রদায়ের নিকটে ইবরাহীমের দাওয়াত ও তাদের জবাবকে আল্লাহ অন্যত্র নিম্নরূপে বর্ণনা করেন। যেমন-


إِذْ قَالَ لِأَبِيْهِ وَقَوْمِهِ مَا هَذِهِ التَّمَاثِيْلُ الَّتِيْ أَنْتُمْ لَهَا عَاكِفُوْنَ، قَالُوْا وَجَدْنَا آبَاءنَا لَهَا عَابِدِيْنَ، قَالَ لَقَدْ كُنْتُمْ أَنْتُمْ وَآبَاؤُكُمْ فِيْ ضَلاَلٍ مُّبِيْنٍ، قَالُوْا أَجِئْتَنَا بِالْحَقِّ أَمْ أَنْتَ مِنَ اللاَّعِبِيْنَ، قَالَ بَل رَّبُّكُمْ رَبُّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ الَّذِيْ فَطَرَهُنَّ وَأَنَا عَلَى ذَلِكُم مِّنَ الشَّاهِدِيْنَ، وَتَاللهِ لَأَكِيْدَنَّ أَصْنَامَكُم بَعْدَ أَن تُوَلُّوْا مُدْبِرِيْنَ- (الأنبياء ৫২-৫৭)-


ইবরাহীম স্বীয় পিতা ও সম্প্রদায়কে বলল, ‘এই মূর্তিগুলি কী যাদের তোমরা পূজারী হয়ে বসে আছ’?(আম্বিয়া ২১/৫২)। ‘তারা বলল, আমরা আমাদের বাপ-দাদাদেরকে এরূপ পূজা করতে দেখেছি’(৫৩)। ‘সে বলল, তোমরা প্রকাশ্য গুমরাহীতে লিপ্ত আছ এবং তোমাদের বাপ-দাদারাও’ (৫৪)। ‘তারা বলল, তুমি কি আমাদের কাছে সত্যসহ এসেছ, না কেবল কৌতুক করছ’? (৫৫)। ‘সে বলল, না। তিনিই তোমাদের পালনকর্তা, যিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের পালনকর্তা, যিনি এগুলো সৃষ্টি করেছেন এবং আমি এ বিষয়ে তোমাদের উপর অন্যতম সাক্ষ্যদাতা’(৫৬)। ‘আল্লাহর কসম! যখন তোমরা ফিরে যাবে, তখন আমি তোমাদের মূর্তিগুলোর ব্যাপারে একটা কিছু করে ফেলব’ (আম্বিয়া ২১/৫২-৫৭)।


দাওয়াতের সারকথা ও ফলশ্রুতি :


মূর্তিপূজারী পিতা ও সম্প্রদায়ের নেতাদের নিকটে ইবরাহীমের দাওয়াত ও তাদের প্রদত্ত জবাবের সার কথাগুলি নিম্নরূপ:


১. ইবরাহীম তাদেরকে এক আল্লাহর ইবাদতের দিকে দাওয়াত দেন। তিনি মূর্তি পূজার অসারতার বিষয়টি তাদের সামনে বলে দেন। কেননা এটি ছিল সকলের সহজবোধ্য। কিন্তু তারা মূর্তিপূজার অসীলা ছাড়তে রাযী হয়নি। কারণ শিরকী প্রথার মধ্যে নেতাদের লাভ ছিল মাল-সম্পদ ও দুনিয়াবী সম্মানের নগদ প্রাপ্তি। পক্ষান্তরে আল্লাহর ইবাদতের মধ্যে এসবের প্রাপ্তি যোগ নেই। শিরকী পূজা-পার্বনের মধ্যে গরীবদের লাভ ছিল এই যে, এর ফলে তারা নেতাদের কাছ থেকে দুনিয়াবী সহযোগিতা পেত। এ ছাড়াও বিভিন্ন কাল্পনিক ও ভ্রান্ত বিশ্বাস তাদেরকে মূর্তিপূজায় প্ররোচিত করত। পক্ষান্তরে একনিষ্ঠ তাওহীদ বিশ্বাস তাদেরকে এসব থেকে বিরত থাকতে উদ্বুদ্ধ করে। যেখানে এক আল্লাহর গোলামীর অধীনে বড়-ছোট সবার জন্য সামাজিক সমানাধিকার নিশ্চিত হয়ে যায়।


২. মূর্তিপূজারীদের কোন সঙ্গত জবাব ছিল না। তারা কেবল একটা কথাই বলেছিল যে, এটা আমাদের বাপ-দাদাদের আমল থেকে চলে আসা প্রথা।


৩. ইবরাহীমের এত কিছু বক্তব্যের পরেও এই অন্ধপূজারীরা বলল, আসলেই তুমি কোন সত্য এনেছ, না আমাদের সাথে কৌতুক করছ? কারণ অদৃশ্য অহীর বিষয়টি তাদের বাস্তব জ্ঞানে আসেনি। কিন্তু মূর্তিকে তারা সামনে দেখতে পায়। সেখানে সেবা ও পূজা করে তারা তৃপ্তি পায়।


৪. পিতা তাঁকে মাথা ফাটিয়ে দেওয়ার হুমকি দিল এবং বাড়ী থেকে তাড়িয়ে দিল। কিন্তু তিনি পিতার জন্য আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনার ওয়াদা করলেন। এর মধ্যে পিতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য বোধ ফুটে উঠেছে, যদিও তিনি মুশরিক হন। পরে পিতার কুফরী পরিষ্কার হয়ে গেলে তিনি বিরত হন (তওবাহ ৯/১১৪)।

৫. পিতা বহিষ্কার করলেও সম্প্রদায় তখনও বহিষ্কার করেনি। তাই তিনি পুনরায় দাওয়াতে মনোনিবেশ করলেন। যদিও তার ফলশ্রুতি ছিল পূর্বের ন্যায় শূন্য।


তারকা পূজারীদের সাথে বিতর্ক :


মূর্তি পূজারীদের সাথে বিতর্কের পরে তিনি তারকাপূজারী নেতাদের প্রতি তাওহীদের দাওয়াত দেন। কিন্তু তারাও মূর্তি পূজারীদের ন্যায় নিজ নিজ বিশ্বাসে অটল রইল। অবশেষে তাঁর সাথে তাদের নেতাদের তর্কযুদ্ধ আবশ্যিক হয়ে পড়ে। কেউ কেউ বলেছেন, ইবরাহীমের কওমের লোকেরা একই সাথে মূর্তি ও তারকার পূজা করত। সেটাও অসম্ভব কিছু নয়।


পবিত্র কুরআনে এই তর্কযুদ্ধ একটি অভিনব ও নাটকীয় ভঙ্গিতে প্রকাশ করা হয়েছে, যাতে সহজে আরবীয় পাঠক হৃদয়ে রেখাপাত করে। কেননা হযরত ইবরাহীম (আঃ) ছিলেন সমগ্র আরবের লোকদের পিতামহ। তাঁর প্রতি গোটা আরব জাতি সম্মান প্রদর্শন করত। অথচ তাদের পিতামহ যার বিরুদ্ধে জীবনভর লড়াই করলেন জাহিল আরবরা সেই সব শিরকে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিল। যে কা‘বা গৃহকে ইবরাহীম (আঃ) নির্মাণ করেন এক আল্লাহর ইবাদতের জন্য। তারা সেখানেই মূর্তিপূজা শুরু করে দিয়েছিল। অথচ মুখে আল্লাহকে স্বীকার করত এবং ইবরাহীম ও ইসমাঈল (আঃ)-এর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করত। আজকের মুসলমানদের জন্য এর মধ্যে শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। কেননা তারাও মুখে আল্লাহকে স্বীকার করে এবং শেষনবীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করে। অথচ নিজেরা কবর পূজা ও স্থানপূজার শিরকে লিপ্ত রয়েছে। আল্লাহর বিধানের অবাধ্যতা ও তার পরিবর্তে নিজেদের মনগড়া বিধান সমূহের আনুগত্য তো রয়েছেই। এক্ষণে আমরা কুরআনে বর্ণিত ইবরাহীমের অপর বিতর্ক যুদ্ধটির বিবরণ পেশ করব।-


আল্লাহ বলেন,


وَكَذَلِكَ نُرِيْ إِبْرَاهِيْمَ مَلَكُوْتَ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ وَلِيَكُوْنَ مِنَ الْمُوْقِنِيْنَ، فَلَمَّا جَنَّ عَلَيْهِ اللَّيْلُ رَأَى كَوْكَباً قَالَ هَـذَا رَبِّي فَلَمَّا أَفَلَ قَالَ لا أُحِبُّ الآفِلِيْنَ، فَلَمَّا رَأَى الْقَمَرَ بَازِغاً قَالَ هَـذَا رَبِّيْ فَلَمَّا أَفَلَ قَالَ لَئِن لَّمْ يَهْدِنِيْ رَبِّي لَأَكُوْنَنَّ مِنَ الْقَوْمِ الضَّآلِّيْنَ، فَلَمَّا رَأَى الشَّمْسَ بَازِغَةً قَالَ هَـذَا رَبِّيْ هَـذَا أَكْبَرُ فَلَمَّا أَفَلَتْ قَالَ يَا قَوْمِ إِنِّيْ بَرِيءٌ مِّمَّا تُشْرِكُوْنَ، إِنِّي وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِيْ فَطَرَ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضَ حَنِيْفاً وَّمَا أَنَاْ مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ، وَحَآجَّهُ قَوْمُهُ قَالَ أَتُحَاجُّونِّي فِي اللهِ وَقَدْ هَدَانِ وَلاَ أَخَافُ مَا تُشْرِكُوْنَ بِهِ إِلاَّ أَن يَّشَآءَ رَبِّيْ شَيْئاً وَسِعَ رَبِّيْ كُلَّ شَيْءٍ عِلْماً أَفَلاَ تَتَذَكَّرُوْنَ، وَكَيْفَ أَخَافُ مَا أَشْرَكْتُمْ وَلاَ تَخَافُوْنَ أَنَّكُمْ أَشْرَكْتُمْ بِاللّهِ مَا لَمْ يُنَزِّلْ بِهِ عَلَيْكُمْ سُلْطَاناً فَأَيُّ الْفَرِيْقَيْنِ أَحَقُّ بِالأَمْنِ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ، الَّذِيْنَ آمَنُوا وَلَمْ يَلْبِسُوْا إِيمَانَهُمْ بِظُلْمٍ أُولَـئِكَ لَهُمُ الأَمْنُ وَهُم مُّهْتَدُوْنَ- (الأنعام ৭৫-৮২)-


‘আমি এরূপভাবেই ইবরাহীমকে নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের অত্যাশ্চর্য বস্ত্তসমূহ দেখাতে লাগলাম, যাতে সে দৃঢ়বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়’ (আন‘আম ৬/৭৫)। ‘অনন্তর যখন রাত্রির অন্ধকার তার উপরে সমাচ্ছন্ন হ’ল, তখন সে তারকা দেখে বলল যে, এটি আমার পালনকর্তা। অতঃপর যখন তা অস্তমিত হ’ল, তখন বলল, আমি অস্তগামীদের ভালবাসি না’ (৭৬)। ‘অতঃপর যখন চন্দ্রকে ঝলমল করতে দেখল, তখন সে বলল, এটি আমার পালনকর্তা। কিন্তু পরে যখন তা অস্তমিত হ’ল, তখন বলল, যদি আমার প্রতিপালক আমাকে পথ প্রদর্শন না করেন, তাহ’লে অবশ্যই আমি পথভ্রষ্ট সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব’ (৭৭)। ‘অতঃপর যখন উদীয়মান সূর্যকে ডগমগে দেখতে পেল, তখন বলল, এটিই আমার পালনকর্তা এবং এটিই সবচেয়ে বড়। কিন্তু পরে যখন তা ডুবে গেল, তখন বলল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা যেসব বিষয়কে শরীক কর, আমি ওসব থেকে মুক্ত’ (৭৮)। ‘আমি আমার চেহারাকে ঐ সত্তার দিকে একনিষ্ঠ করছি, যিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সৃষ্টি করেছেন এবং আমি অংশীবাদীদের অন্তর্ভুক্ত নই’ (৭৯)। ‘(তখন) তার সম্প্রদায় তার সাথে বিতর্ক করল। সে বলল, তোমরা কি আমার সাথে আল্লাহ সম্পর্কে বিতর্ক করছ? অথচ তিনি আমাকে সরল পথ দেখিয়েছেন। আর আমি ভয় করিনা তাদের, যাদেরকে তোমরা তাঁর সাথে শরীক কর, তবে আমার পালনকর্তা যদি কিছু (কষ্ট দিতে) চান। আমার প্রভুর জ্ঞান সবকিছুতেই পরিব্যপ্ত। তোমরা কি উপদেশ গ্রহণ করবে না’? (৮০)। ‘কিভাবে আমি ঐসব বস্ত্তকে ভয় করব, যাদেরকে তোমরা তাঁর সাথে শরীক করেছ? অথচ তোমরা এ বিষয়ে ভয় পাওনা যে, তোমরা আল্লাহর সাথে এমন সব বস্ত্তকে শরীক করেছ, যাদের সম্পর্কে আল্লাহ তোমাদের প্রতি কোন প্রমাণ অবতীর্ণ করেননি। এক্ষণে উভয় দলের মধ্যে কে বেশী নিরাপত্তা লাভের অধিকারী? যদি তোমরা জ্ঞানী হয়ে থাক’ (৮১)। ‘যারা ঈমান আনে এবং স্বীয় ঈমানকে শিরকের সাথে মিশ্রিত করে না, তাদের জন্যই রয়েছে নিরাপত্তা এবং তারাই হ’ল সুপথপ্রাপ্ত’ (আন‘আম ৬/৭৫-৮২)।

উপরের বর্ণনা ভঙ্গিতে মনে হয় যেন ইবরাহীম ঐ দিনই প্রথম নক্ষত্র, চন্দ্র ও সূর্য দেখলেন এবং ‘এটি আমার পালনকর্তা’ বলে সাময়িকভাবে মুশরিক হয়েছিলেন। পরে শিরক পরিত্যাগ করে মুসলিম হ’লেন। অথচ ঘটনা মোটেই তা নয়। কেননা ঐ সময় ইবরাহীম (আঃ) অন্যূন সত্তরোর্ধ্ব বয়সের নবী। আর নবীগণ জন্ম থেকেই নিষ্পাপ ও শিরকমুক্ত থাকেন। আসল কথা হ’ল এই যে, মূর্তি পূজার অসারতা বুঝানো যতটা সহজ ছিল, তারকা পূজার অসারতা বুঝানো ততটা সহজ ছিল না। কেননা ওটা মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাই ইবরাহীম (আঃ) এখানে বৈজ্ঞানিক পন্থা বেছে নিলেন এবং জনগণের সহজবোধ্য এমন একটি প্রমাণ উপস্থাপন করলেন, যাতে তাদের লা-জওয়াব হওয়া ব্যতীত কোন উপায় ছিল না। তিনি সৌরজগতের গতি-প্রকৃতি যে আল্লাহর হুকুমের অধীন, সে কথা না বলে তাদের অস্তমিত হওয়ার বিষয়টিকে প্রমাণ হিসাবে পেশ করেন। কারণ এটাই ছিল তাদের জন্যে সহজবোধ্য। তিনি বলেন, যা ক্ষয়ে যায়, ডুবে যায়, হারিয়ে যায়, নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পারে না, ধরে রাখতে পারে না, বরং দৈনিক ওঠে আর ডোবে, সে কখনো মানুষের প্রতিপালক হ’তে পারে না। বরং সর্বোচ্চ পালনকর্তা কেবল তিনিই হ’তে পারেন, যিনি এসব কিছুর সৃষ্টিকর্তা ও বিধানদাতা। আর তিনিই হ’লেন ‘আল্লাহ’। আমি তাঁর দিকেই ফিরে গেলাম এবং বাপ-দাদার আমল থেকে তোমরা যে শিরক করে আসছ, আমি তা থেকে নিজেকে মুক্ত ঘোষণা করলাম।


বলা বাহুল্য, এর অন্তর্নিহিত দাওয়াত ছিল এই যে, হে আমার জাতি! তোমরাও আমার মত আল্লাহর দিকে ফিরে এসো এবং শিরক হ’তে মুক্ত হও। কিন্তু ইবরাহীমের এই তর্কযুদ্ধ নিষ্ফল হ’ল। সম্প্রদায়ের নেতারা নিজ নিজ মতের উপরে দৃঢ় রইল। কেউ তাঁর আহবানে সাড়া দিল না।


একটি সংশয় ও তার জওয়াব :

৭৫ হ’তে ৮২ পর্যন্ত ৮টি আয়াতে যে বিষয়গুলি আলোচিত হয়েছে, এটি ইবরাহীমের শিশুকালে জ্ঞান-বুদ্ধির বয়স হবার সময়কার ঘটনা, নাকি নবী হবার পরের তর্কানুষ্ঠান, এ বিষয়ে বিদ্বানগণ মতভেদ করেছেন। ইবনু জারীর (মৃঃ ৩১০ হিঃ) প্রথমোক্ত মত পোষণ করেন। তিনি এ বিষয়ে আলী ইবনে ত্বালহার সূত্রে ইবনু আববাস (রাঃ)-এর বর্ণনা পেশ করেছেন। তবে এই বর্ণনাটির সনদ যঈফ।[7]


মুহাম্মাদ ইবনু ইসহাক্ব (৮৫-১৫০ হিঃ) বর্ণিত কিছু অলৌকিক ঘটনা উল্লেখিত হয়েছে, যা উক্ত মতকে সমর্থন করে। যেমন বাদশাহ নমরূদ যখন জানতে পারেন যে, অচিরেই একটি পুত্র সন্তান জন্মলাভ করবে, যে তার রাজ্য হারানোর কারণ হবে, তখন তিনি নবজাতক সকল পুত্র সন্তানকে হত্যা করার নির্দেশ জারি করেন। ইবরাহীমের মা তখন একটি পাহাড়ের গোপন গুহায় লুকিয়ে ইবরাহীমকে প্রসব করেন এবং ইবরাহীম একাকী সেখানে বড় হন। ইবরাহীমের এক আঙ্গুল দিয়ে দুধ বের হ’ত, এক আঙ্গুল দিয়ে মধু বের হ’ত ও এক আঙ্গুল দিয়ে পানি বের হ’ত। এভাবে তিনি সেখানে তিন বছর কাটান। তারপর তিনি সেখান থেকে বের হয়ে এসে মাকে বলেন, আমার প্রভু কে? মা বললেন, নমরূদ। তিনি বললেন, নমরূদের প্রভু কে? তখন মা তাকে চড় মারলেন এবং তিনি বুঝলেন এটিই হ’ল সেই ছেলে, যার সম্পর্কে বাদশাহ নমরূদ আগেই স্বপ্ন দেখেছেন। সুদ্দী, যাহহাক প্রমুখের বরাতে কাসাঈ স্বীয় ক্বাছাছুল আম্বিয়ার মধ্যে এ ধরনের অনেক অলৌকিক ঘটনা বর্ণনা করেছেন (ইবনু কাছীর, কুরতুবী)। অতঃপর ইবরাহীম গুহা থেকে বের হয়ে প্রথম তারকা দেখলেন, তারপর চন্দ্র দেখলেন, তারপর সূর্য দেখলেন। অতঃপর সবকিছুর ডুবে যাওয়া দেখে নিজেই সিদ্ধান্ত নিলেন যে, প্রকৃত পালনকর্তা তিনি, যিনি এগুলিকে সৃষ্টি করেছেন (কুরতুবী)। ইবনু জারীর দলীল এনেছেন ইবরাহীমের একথা দ্বারা, যেখানে তিনি বলেছেন, لَئِن لَّمْ يَهْدِنِي رَبِّي لأكُونَنَّ مِنَ الْقَوْمِ الضَّالِّينَ، ‘যদি আমার প্রতিপালক আমাকে পথ না দেখান, তাহ’লে অবশ্যই আমি পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব’ (আন‘আম ৬/৭৭)।


ইবনু কাছীর (৭০১-৭৭৪ হিঃ) বলেন, বরং সঠিক কথা এই যে, ইবরাহীমের উপরোক্ত ঘটনা ছিল তার কওমের সাথে একটি তর্কানুষ্ঠান মাত্র। এটি কখনোই তার শিশুকালের ঘটনা নয় এবং তিনি ক্ষণিকের তরেও কখনো মুশরিক হননি। কেননা তাঁর সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, إِنَّ إِبْرَاهِيمَ كَانَ أُمَّةً قَانِتاً لِلّهِ حَنِيفاً وَلَمْ يَكُ مِنَ الْمُشْرِكِينَ، ‘নিশ্চয়ই ইবরাহীম ছিলেন একটি উম্মত এবং আল্লাহর প্রতি অনুগত ও একনিষ্ঠ। আর তিনি কখনোই মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না’ (নাহল ১৬/১২০)। তাছাড়া প্রত্যেক মানব শিশুই জন্মগতভাবে আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ থাকে। যেমন আল্লাহ বলেন, خَلَقْتُ عبادى حُنَفَاءَ ‘আমি আমার বান্দাদের সৃষ্টি করি আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ হিসাবে’।[8] সাধারণ মানবশিশু যদি এরূপ হয়, তাহ’লে শিশু ইবরাহীম কেন মুশরিক হবেন? আর এটা যে কওমের নেতাদের সাথে তাঁর একটি তর্কানুষ্ঠান ছিল, তার বড় প্রমাণ এই যে, ৮০ নং আয়াতে বলা হয়েছে وَحَآجَّهُ قَوْمُهُ ‘তাঁর কওম তাঁর সাথে বিতর্ক করল’। তাছাড়া তর্ক শেষে তিনি তাদের উদ্দেশ্যে বললেন, يَا قَوْمِ إِنِّي بَرِيءٌ مِّمَّا تُشْرِكُونَ، ‘হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা যেসব বিষয়কে শরীক কর, আমি ওসব থেকে মুক্ত’ (আন‘আম ৬/৭৮)।

Post a Comment

Previous Post Next Post