হযরত ছালেহ (আলাইহিস সালাম)-2
ছালেহ (আঃ)-এর দাওয়াতের ফলশ্রুতি :
ইতিপূর্বেকার ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিগুলির ন্যায় কওমে ছামূদও তাদের নবী হযরত ছালেহ (আঃ)-কে অমান্য করে। তারা বিগত ‘আদ জাতির ন্যায় পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করতে থাকে। নবী তাদেরকে যতই দাওয়াত দিতে থাকেন, তাদের অবাধ্যতা ততই সীমা লংঘন করতে থাকে। ‘তারা বলল,
قَالُوْا يَا صَالِحُ قَدْ كُنْتَ فِيْنَا مَرْجُوًّا قَبْلَ هَذَا أَتَنْهَانَا أَن نَّعْبُدَ مَا يَعْبُدُ آبَاؤُنَا وَإِنَّنَا لَفِيْ شَكٍّ مِّمَّا تَدْعُوْنَا إِلَيْهِ مُرِيْبٍ- (هود ৬২)-
হে ছালেহ! ইতিপূর্বে আপনি আমাদের কাছে আকাংখিত ব্যক্তি ছিলেন। আপনি কি বাপ-দাদার আমল থেকে চলে আসা উপাস্যদের পূজা করা থেকে আমাদের নিষেধ করছেন? অথচ আমরা আপনার দাওয়াতের বিষয়ে যথেষ্ট সন্দিহান’ (হূদ ১১/৬২)। তারা কওমের দুর্বল ও দরিদ্র শ্রেণীর লোকদের জমা করে বলল,أَتَعْلَمُوْنَ أَنَّ صَالِحاً مُّرْسَلٌ مِّن رَّبِّهِ- ‘তোমরা কি বিশ্বাস কর যে, ছালেহ তার প্রভুর পক্ষ হ’তে প্রেরিত ব্যক্তি’? তারা জবাব দিল, إِنَّابِمَا أُرْسِلَ بِهِ مُؤْمِنُوْنَ- ‘আমরা তো তাঁর আনীত বিষয়ের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনকারী’। একথা শুনে দাম্ভিক নেতারা ক্ষিপ্ত হয়ে বলে উঠল, ‘তোমরা যে বিষয়ে ঈমান এনেছ, আমরা ঐসব কিছুকে অস্বীকার করি’ (আ‘রাফ ৭/৭৫)। তারা আরও বলল,
فَقَالُوا أَبَشَرًا مِّنَّا وَاحِدًا نَّتَّبِعُهُ إِنَّا إِذًا لَّفِيْ ضَلاَلٍ وَسُعُرٍ- أَؤُلْقِيَ الذِّكْرُ عَلَيْهِ مِن بَيْنِنَا بَلْ هُوَ كَذَّابٌ أَشِرٌ- (القمر ২৪-২৫)-
‘আমরা কি আমাদেরই একজনের অনুসরণ করব? তাহ’লে তো আমরা বিপথগামী ও বিকারগ্রস্ত বলে গণ্য হব’। ‘আমাদের মধ্যে কি কেবল তারই উপরে অহী নাযিল করা হয়েছে? আসলে সে একজন মহা মিথ্যাবাদী ও দাম্ভিক’ (ক্বামার ৫৪/২৪-২৫)। তারা ছালেহকে বলল, قَالُوا اطَّيَّرْنَا بِكَ وَبِمَن مَّعَكَ ...- ‘আমরা তোমাকে ও তোমার সাথে যারা আছে তাদেরকে অকল্যাণের প্রতীক মনে করি’... (নামল ২৭/৪৭)। এইভাবে সমাজের শক্তিশালী শ্রেণী তাদের নবীকে অমান্য করল এবং মূর্তিপূজা সহ নানাবিধ শিরক ও কুসংস্কারে লিপ্ত হ’ল এবং সমাজে অনর্থ সৃষ্টি করতে থাকল। আল্লাহর ভাষায়, فَاسْتَحَبُّوا الْعَمَى عَلَى الْهُدَى فَأَخَذَتْهُمْ صَاعِقَةُ الْعَذَابِ الْهُوْنِ بِمَا كَانُوْا يَكْسِبُوْنَ- ‘তারা হেদায়াতের চাইতে অন্ধত্বকেই পসন্দ করে নিল। অতঃপর তাদের কৃতকর্মের ফলে অবমাননাকর শাস্তির গর্জন এসে তাদের পাকড়াও করল’ (ফুছছিলাত/হামীম সাজদাহ ৪১/১৭)।
কওমে ছামূদ-এর উপরে আপতিত গযবের বিবরণ :
ইবনু কাছীর বর্ণনা করেন যে, হযরত ছালেহ (আঃ)-এর নিরন্তর দাওয়াতে অতিষ্ঠ হয়ে সম্প্রদায়ের নেতারা স্থির করল যে, তাঁর কাছে এমন একটা বিষয় দাবী করতে হবে, যা পূরণ করতে তিনি ব্যর্থ হবেন এবং এর ফলে তাঁর দাওয়াতও বন্ধ হয়ে যাবে। সেমতে তারা এসে তাঁর নিকটে দাবী করল যে, আপনি যদি আল্লাহর সত্যিকারের নবী হন, তাহ’লে আমাদেরকে নিকটবর্তী ‘কাতেবা’ পাহাড়ের ভিতর থেকে একটি দশ মাসের গর্ভবতী সবল ও স্বাস্থ্যবতী উষ্ট্রী বের করে এনে দেখান।
Md Sufiyan, [6/18/2025 5:37 PM]
এ দাবী শুনে হযরত ছালেহ (আঃ) তাদের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিলেন যে, যদি তোমাদের দাবী পুরণ করা হয়, তবে তোমরা আমার নবুঅতের প্রতি ও আমার দাওয়াতের প্রতি ঈমান আনবে কি-না। জেনে রেখ, উক্ত মু‘জেযা প্রদর্শনের পরেও যদি তোমরা ঈমান না আনো, তাহ’লে আল্লাহর গযবে তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে’। এতে সবাই স্বীকৃত হ’ল ও উক্ত মর্মে অঙ্গীকার করল। তখন ছালেহ (আঃ) ছালাতে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করলেন। আল্লাহ পাক তার দো‘আ কবুল করলেন এবং বললেন, إِنَّا مُرْسِلُو النَّاقَةِ فِتْنَةً لَّهُمْ فَارْتَقِبْهُمْ وَاصْطَبِرْ ‘আমরা তাদের পরীক্ষার জন্য একটি উষ্ট্রী প্রেরণ করব। তুমি তাদের প্রতি লক্ষ্য রাখ এবং ধৈর্য ধারণ কর’ (ক্বামার ৫৪/২৭)। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাহাড়ের গায়ে কম্পন দেখা দিল এবং একটি বিরাট প্রস্তর খন্ড বিস্ফোরিত হয়ে তার ভিতর থেকে কওমের নেতাদের দাবীর অনুরূপ একটি গর্ভবতী ও লাবণ্যবতী তরতাযা উষ্ট্রী বেরিয়ে এল।
ছালেহ (আঃ)-এর এই বিস্ময়কর মু‘জেযা দেখে গোত্রের নেতা সহ তার সমর্থক লোকেরা সাথে সাথে মুসলমান হয়ে গেল। অবশিষ্টরাও হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করল। কিন্তু প্রধান ধর্মনেতা ও অন্যান্য সমাজ নেতাদের বাধার কারণে হ’তে পারল না। তারা উল্টা বলল, قَالُوا اطَّيَّرْنَا بِكَ وَبِمَن مَّعَكَ ...- ‘আমরা তোমাকে ও তোমার সাথে যারা আছে তাদেরকে অকল্যাণের প্রতীক মনে করি...’ (নামল ২৭/৪৭)। হযরত ছালেহ (আঃ) কওমের নেতাদের এভাবে অঙ্গীকার ভঙ্গ করতে দেখে এবং পাল্টা তাঁকেই দায়ী করতে দেখে দারুণভাবে শংকিত হ’লেন যে, যেকোন সময়ে এরা আল্লাহর গযবে ধ্বংস হয়ে যাবে। তিনি তাদেরকে সাবধান করে বললেন, قَالَ طَائِرُكُمْ عِنْدَ اللَّهِ بَلْ أَنتُمْ قَوْمٌ تُفْتَنُوْنَ- ‘দেখ, তোমাদের মঙ্গলামঙ্গল আল্লাহর নিকটে রয়েছে। বরং তোমরা এমন সম্প্রদায়, যাদেরকে পরীক্ষা করা হচ্ছে’ (নামল ২৭/৪৭)। অতঃপর পয়গম্বরসূলভ দয়া প্রকাশ করে বললেন,
هَـذِهِ نَاقَةُ اللّهِ لَكُمْ آيَةً فَذَرُوْهَا تَأْكُلْ فِيْ أَرْضِ اللّهِ وَلاَ تَمَسُّوْهَا بِسُوْءٍ فَيَأْخُذَكُمْ عَذَابٌ قَرِيْبٌ- (هود ৬৪)-
‘এটি আল্লাহর উষ্ট্রী। তোমাদের জন্য নিদর্শন স্বরূপ। একে আল্লাহর যমীনে স্বাধীনভাবে চরে বেড়াতে দাও। সাবধান! একে অসৎ উদ্দেশ্যে স্পর্শ করো না। তাহ’লে তোমাদেরকে সত্বর যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি পাকড়াও করবে’ (হূদ ১১/৬৪)।
আল্লাহ উক্ত উষ্ট্রীর জন্য এবং লোকদের জন্য পানি বণ্টন করে দিয়েছিলেন। তিনি নবীকে বলে দেন, َنَبِّئْهُمْ أَنَّ الْمَاءَ قِسْمَةٌ بَيْنَهُمْ كُلُّ شِرْبٍ مُّحْتَضَرٌ ‘হে ছালেহ! তুমি ওদেরকে বলে দাও যে, কূপের পানি তাদের মধ্যে বণ্টিত হয়েছে। প্রত্যেক পালায় তারা হাযির হবে’ (ক্বামার ৫৪/২৮)।
لَّهَا شِرْبٌ وَلَكُمْ شِرْبُ يَوْمٍ مَّعْلُوْمٍ- ‘একদিন উষ্ট্রীর ও পরের দিন তোমাদের (পানি পানের) জন্য পালা নির্ধারিত হয়েছে’ (ক্বামার ৫৪/২৮; শো‘আরা ২৬/১৫৫)।
আল্লাহ তা‘আলা কওমে ছামূদ-এর জন্য উক্ত উষ্ট্রীকেই সর্বশেষ পরীক্ষা হিসাবে নির্ধারণ করেছিলেন। তিনি বলেন, وَآتَيْنَا ثَمُوْدَ النَّاقَةَ مُبْصِرَةً فَظَلَمُوْا بِهَا وَمَا نُرْسِلُ بِالآيَاتِ إِلاَّ تَخْوِيْفًا- ‘আর আমরা ছামূদকে উষ্ট্রী দিয়েছিলাম স্পষ্ট নিদর্শন হিসাবে। কিন্তু তারা তার প্রতি যুলুম করেছিল। বস্ত্ততঃ আমরা ভীতি প্রদর্শনের উদ্দেশ্যেই নিদর্শন সমূহ প্রেরণ করে থাকি’ (ইসরা ১৭/৫৯)।
Md Sufiyan, [6/18/2025 5:40 PM]
ছামূদ জাতির লোকেরা যে কূপ থেকে পানি পান করত ও তাদের গবাদি পশুদের পানি পান করাত, এ উষ্ট্রীও সেই কূপ থেকে পানি পান করত। উষ্ট্রী যেদিন পানি পান করত, সেদিন কূয়ার পানি নিঃশেষে পান করে ফেলত। অবশ্য ঐদিন লোকেরা উষ্ট্রীর দুধ পান করত এবং বাকী দুধ দ্বারা তাদের সব পাত্র ভরে নিত। কিন্তু এই হতভাগাদের কপালে এত সুখ সহ্য হ’ল না। তারা একদিন পানি না পাওয়াকে অসুবিধার কারণ হিসাবে গণ্য করল। তাছাড়া উষ্ট্রী যখন ময়দানে চরে বেড়াত, তখন তার বিশাল দেহ ও অপরূপ চেহারা দেখে অন্যান্য গবাদি পশু ভয় পেত। ফলে তারা উষ্ট্রীকে মেরে ফেলতে মনস্থ করল। কিন্তু আল্লাহর গযবের ভয়ে কেউ সাহস করল না।
ইবনু জারীর প্রমুখ মুফাসসিরগণের বর্ণনা মতে, অবশেষে শয়তান তাদেরকে সর্ববৃহৎ কুমন্ত্রণা দিল। আর তা হ’ল নারীর প্রলোভন। ছামূদ গোত্রের দু’জন পরমা সুন্দরী মহিলা, যারা ছালেহ (আঃ)-এর প্রতি দারুণ বিদ্বেষী ছিল, তারা তাদের রূপ-যৌবন দেখিয়ে দু’জন পথভ্রষ্ট যুবককে উষ্ট্রী হত্যায় রাযী করালো। অতঃপর তারা তীর ও তরবারির আঘাতে উষ্ট্রীকে পা কেটে হত্যা করে ফেলল। হত্যাকারী যুবকদ্বয়ের প্রধানকে লক্ষ্য করেই কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, إِذِ انْبَعَثَ أَشْقَاهَا ‘যখন তাদের সবচেয়ে হতভাগা লোকটি তৎপর হয়ে উঠেছিল’ (শাম্স ৯১/১২)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদা খুৎবায় উক্ত আয়াত পাঠ করে বলেন, ঐ লোকটি ছিল কঠোর হৃদয় ও দুশ্চরিত্র (رجل عزيز عارم )।[4] কেননা তার কারণেই গোটা ছামূদ জাতি গযবে পতিত হয়। আল্লাহ বলেন,
فَنَادَوْا صَاحِبَهُمْ فَتَعَاطَى فَعَقَرَ، فَكَيْفَ كَانَ عَذَابِي وَنُذُرِ، إِنَّا أَرْسَلْنَا عَلَيْهِمْ صَيْحَةً وَاحِدَةً فَكَانُوْا كَهَشِيْمِ الْمُحْتَظِرِ-
‘অতঃপর তারা তাদের প্রধান ব্যক্তিকে ডাকল। অতঃপর সে উষ্ট্রীকে ধরল ও বধ করল’ (২৯)। ‘অতঃপর কেমন কঠোর ছিল আমার শাস্তি ও ভীতি প্রদর্শন! (৩০)। ‘আমরা তাদের প্রতি প্রেরণ করলাম একটিমাত্র নিনাদ। আর তাতেই তারা হয়ে গেল খোয়াড় মালিকের চূর্ণিত শুষ্ক খড়কুটো সদৃশ’ (ক্বামার ৫৪/২৯-৩১)।
উল্লেখ্য যে, উষ্ট্রী হত্যার ঘটনার পর ছালেহ (আঃ) স্বীয় কওমকে আল্লাহর নির্দেশ জানিয়ে দিলেন যে, تَمَتَّعُوْا فِيْ دَارِكُمْ ثَلاَثَةَ أَيَّامٍ ذَلِكَ وَعْدٌ غَيْرُ مَكْذُوْبٍ- ‘এখন থেকে তিনদিন তোমরা তোমাদের ঘরে আরাম করে নাও (এর পরেই আযাব নেমে আসবে)। এ ওয়াদার (অর্থাৎ এ সময়সীমার) কোন ব্যতিক্রম হবে না’ (হূদ ১১/৬৫)। কিন্তু এই হতভাগারা এরূপ কঠোর হুঁশিয়ারির কোন গুরুত্ব না দিয়ে বরং তাচ্ছিল্যভরে বলল, يَا صَالِحُ ائْتِنَا بِمَا تَعِدُنَا إِنْ كُنْتَ مِنَ الْمُرْسَلِيْنَ ‘হে ছালেহ! তুমি যার ভয় দেখাচ্ছ, তা নিয়ে আস দেখি, যদি তুমি সত্যিকারের নবী হয়ে থাক’ (আ‘রাফ ৭/৭৭)। তারা বলল, আমরা জানতে চাই, এ শাস্তি কিভাবে আসবে, কোত্থেকে আসবে, এর লক্ষণ কি হবে? ছালেহ (আঃ) বললেন, আগামীকাল বৃহষ্পতিবার তোমাদের সকলের মুখমন্ডল হলুদ হয়ে যাবে। পরের দিন শুক্রবার তোমাদের সবার মুখমন্ডল লালবর্ণ ধারণ করবে। অতঃপর শনিবার দিন সবার মুখমন্ডল ঘোর কৃষ্ণবর্ণ হয়ে যাবে। এটাই হবে তোমাদের জীবনের শেষ দিন।[5]
Tags
ইসলামিক কাহিনী