হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর জীবনী(৪)

 হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর জীবনী


নিপীড়নের মাত্রা বেড়ে গেলো। ইয়াসের, সুমাইয়্যা ও তাদের সন্তান আম্মারের বেলায় তাই ঘটেছে। খোদাদ্রোহীদের নির্যাতনে পিতা-মাতা শহীদ হন। নির্যাতনের কারণেই তাঁর মৃত্যু হয়। বিলাল বিন রাবাহ আবুজেহেলের ও উমায়্যা বিন খালাফের অকথ্য নির্যাতনের শিকার হন। অবশ্যই বিলাল আবূ বাকারের (রা) মাধ্যমে ইসলাম গ্রহণ করেন। এ খবর শুনে তাঁর মালিক অত্যাচারের শিকার হন। অবশ্যই বিলাল হযরত আবু বাকারের (রাঃ) মাধ্যমে ইসলাম গ্রহণ করেন। এ খবর শুনে তাঁর মালিক অত্যাচারের সব পন্থা অবলম্বন করে যাতে বিলাল ইসলাম ত্যাগ করে। কিন্তু তিনি আকঁড়ে ধরেন ইসলামকে এবং অস্বীকার করেন ইসলাম ত্যাগ করতে। উমায়্যা তাঁকে শিকলাবন্ধ করে মক্কার বাইরে নিয়ে গিয়ে বুকের উপর বিরাট পাথর রেখে উত্তপ্ত বালিতে হেঁচড়িয়ে টানতো। অতঃপর সে ও তাঁর সঙ্গীরা বেত্রাঘাত করতো আর বিলাল শুধু আহাদ, আহাদ, এক, এক, বলতে থাকতেন। এহেন অবস্থায় একবার আবূ বকর তাকে দেখেন। তিনি বিলালকে উমায়্যার কাছ থেকে ক্রয় করে নিয়ে আল্লাহর নিমিত্তে স্বাধীন করে দেন। এ সব পৈশাচিক ও বর্বর অত্যাচারের কারণে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদেরকে ইসলাম প্রকাশ করতে নিষেধ করেন। তাদের সাথে মিলিত হতেন অত্যন্ত সংগোপনে। কেননা প্রকাশ্যভাবে মিলিত হলে মুশরিকরা রাসূলের শিক্ষা প্রদানের পথে অন্তরায়ের সৃষ্টি করবে কখনো দুদলের সংঘর্ষের আশংকাও ছিল। এ কথা সুবিদিত যে এহেন নাজুক পরিস্থিতিতে সংঘর্ষ মুসলমানদের ধ্বংস ও সমূলে বিনাশই ডেকে আনবে। কারণ মুসলমানদের সংখ্যা ও শক্তি সামর্থ্য ছিল খুবই স্বল্প। তাই তাদের ইসলাম গোপন রাখাটাই ছিল দূরদর্শিতা। অবশ্য রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাফেরদের অত্যাচার সত্ত্বেও প্রকাশ্যভাবে দাওয়াত ও ইবাদতের কাজ করতেন।


হাবশার দিকে হিজরত :


যার ইসলামের কথা ফাঁস হয়ে যেত তিনি মুশরিকদের নিপীড়নের সহজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হতেন। বিশেষত দুর্বল মুসলিমরা। এ পরিপ্রেক্ষিতে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সহাবীদেরকে দ্বীন নিয়ে হাবশায় (ইথিওপিয়া) হিজরত করার নির্দেশ দেন। তিনি সেখানকার শাসক নাজাসীর নিকট নিরাপত্তা পাওয়ার আশ্বাস দেন। অনেক মুসলমান নিজের জান ও পরিবার বর্গের ব্যাপারে নিরাপত্তাহীনতায় ভূগতো। তাই নবুওয়াতের ৫ম বছরে প্রায় ৭০ জন মুসলিম সপরিবারে হিজরত করেন। তাঁদের মধ্যে উসমান বিন আফফান ও তাঁর স্ত্রী রুকাইয়্যাও ছিলেন। এ দিকে কুরাইশরা ইথিওপিয়ায় হিজরত কারীদের অবস্থান ব্যাহত করার চেষ্টা করে। সে দেশের রাজার জন্য পাঠায় উৎকোচ। পলায়নকারীদের (মুহাজির) বহিস্কারের অনুরোধ জানায়। তারা আরো বলে যে, মুসলিমরা ঈসা আলাইহিস সালাম ও মরিয়াম সম্পর্কে অপমানকর ও অশিষ্ট বাক্য ব্যবহার করে। নাজাসী তাদেরকে ঈসা আলাইহিস সালাম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তাঁরা সত্যটি সুস্পষ্ট ভাবে বলে দেন, শাসক মুসলিমদের আশ্রয় দেন এবং বহিস্কার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। এ বছরের রমযান মাসে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম হারাম শরীফে যান। সেখানে ছিল কুরাইশেরএক দল লোক। তিনি দাঁড়িয়ে হঠাৎ করে তাদের সামনে সুরায়ে নাজম তেলাওয়াত করতে লাগলেন। এ সব কাফেররা ইতিপূর্বে কখনো আল্লাহর বাণী শুনেনি। কেননা তাঁরা রাসূলের কিছুই না শুনার পদ্ধতি অনুসরণ করে আসতেছিলো। আকস্মাৎ তেলাওয়াতের মধুর ধ্বনি তাদের কর্ণে গেলে তাঁরা আল্লাহর হৃদয়গ্রাহী চিত্তাকর্ষক বাণী ও সাবলীল ভাষা একাগ্রচিত্তে শুনে। অন্তরে তা ছাড়া অন্য কিছুই নেই। এক পর্যায়ে রাসূল— ﴿ فَٱسۡجُدُواْۤ لِلَّهِۤ وَٱعۡبُدُواْ۩ ٦٢﴾ [النجم:62] আয়াতটি পড়ে সেজদায় চলে যান। উপস্থিত ব্যাক্তিদের মধ্যে কেউ নিজেদেরকে নিয়ন্ত্রন করতে পারেনি। তাঁরাও সেজদায় চলে যায়। অনুপস্থিত মুশরিকরা তাদেরকে তিরস্কার করে, ভৎসনা করে। অন্য কোন উপায় না দেখে এরা রাসূলের বিরুদ্ধে মিথ্যা রচনা করে যে, তিনি তাদের মূর্তির প্রশংসা করেন এবং বলেন, “তাদের (মুর্তিসমূহের) সুপারিশের আশা করা যায়” সেজদা করার অজুহাত স্বরুপ এ ভিত্তিহীন, নিরেট মিথ্যার বেসাতী করে তারা।


ওমরের ইসলাম গ্রহণ :


ওমরের রাদিয়াল্লাহু আনহু ইসলাম গ্রহণ মুসলমানদের জন্য বড় বিজয় ছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে ফারুক বলে আখ্যায়িত করেছেন। কারণ আল্লাহ তা‘আলা তাঁর মাধ্যমে সত্য ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্য সূচিত করেছেন। ইসলাম গ্রহনের কয়েক দিন পরে ওমার রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কি সত্যের উপরে নই? তদুত্তোরে তিনি বললেন কেন নয়, নিশ্চয় আমরা সত্যের মধ্যে। ওমর বললেন তাহলে এত গোপনীয়তা কি জন্যে। তখন আরকামের বাড়ীতে সমাবেত মুসলিমদেরকে নিয়ে বের হয়ে পড়েন এবং তাদেরকে দুদলে বিভক্ত করে দেন। হামযা বিন আব্দুল মুত্তালিবের নেতৃত্বে একদল এবং ওমার বিন খাত্তাবের নেতৃত্বে আর একদলের নব সঞ্চারিত শক্তির ঈঙ্গিত দেয়ার জন্যে মক্কার বিভিন্ন অলি-গলি প্রদক্ষিণ করে। কুরাইশরা দাওয়াত দমন করার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে। শাস্তি, নির্যাতন, নিপীড়ন, প্রলোভন ও হুমকি প্রদর্শনের মতো সর্ব প্রকার পন্থা গ্রহণ করে।


কিন্তু এসব কুপরিকল্পিত ব্যবস্থাসমূহ মুসলমানদের ঈমান বৃদ্ধি ও দ্বীন ইসলামকে অধিকতর আঁকড়ে ধরা ছাড়া আর কোন ভুমিকা রাখতে পারেনি। এক নতুন দুরভিসন্ধি ও মন্দ অভিপ্রায় তাদের অন্তরে জন্ম নিল। আর তা হচ্ছে মুসলমান ও বনী হাশেমকে সম্পূর্ণভাবে বর্জন ও একঘরে করে রাখার এক চুক্তিনামা লিখে, যাতে সবাই সাক্ষর করবে, কাবা শরিফের অভ্যন্তরে ঝুলিয়ে দেবে। চুক্তি অনুসারে তাদের সাথে বেচা- কেনা, বিয়ে শাদি, সাহায্য সহযোগিতা, ও লেন-দেন সম্পূর্ণভাবে বন্ধ থাকবে। এ চুক্তির ফলে মুসলিমরা বাধ্য হয়ে মক্কা থেকে বের হয়ে (শো’বে আবি তালেব নামক) এক উপত্যাকায় গিয়ে আশ্রয় নেন। তাঁরা অবর্ণনীয় ক্লেশ ও দুঃখের শিকার হন সেখানে। ক্ষুধা ও অর্ধাহারের বিষাক্ত ছবোল থেকে কেউ রক্ষা পায়নি। স্বচ্ছল ও সামর্থবান ব্যক্তিরা নিজেদের সমস্ত ধন-সম্পদ ব্যয় করে ফেলেন। খাদীজা তাঁর সম্পূর্ণ অর্থ ব্যয় করেন। বিভিন্ন রোগ ছাড়িয়ে পড়লো। অধিকাংশ লোকই মৃত্যূর প্রায়-দ্বার প্রান্তে এসে দাড়ালেন। কিন্ত তাঁরা ধৈর্য অবিচলতার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেন। তাঁদের মধ্যে একজনও পশ্চাদপদ হননি। অবরোধ একাধারে তিন বছর স্থায়ী রইল। অতঃপর বনী হাশেমের সাথে আত্মীয়তা আছে এমন কিছু শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি জনসমাবেশে চুক্তি ভঙ্গ করার কথা ঘোষনা করে। চুক্তির কাগজ বের করা হলে দেখা যায় যে সেটা খেয়ে ফেলা হয়েছে। শুধুমাত্র কাগজের এক কোণ যেখানে “বিসমিকা আল্লাহুম্মা” লেখাছিল সেটাই অক্ষত রয়েছে। সংকটের অবসান হল। আর মুসলিম ও বনী হাশেম মক্কায় ফিরে আসেন। কিন্তু কুরাইশরা মুসলিমদের দমন ও মুকাবিলায় সেই রকম রুঢ়তা ও কঠোরতা ক্ষনিকের তরেও পরিহার করেনি।


চন্দ্র দু টুকরা হওয়া :


মুশরিকরা অনেক সময় রাসূলকে অপারগ, অক্ষম সাব্যস্ত করার ফন্দিতে বিভিন্ন অলৌকিক নির্দশন দেখানোর দাবী করতো। আর এধরনের দাবী জানায়, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর কাছে দোয়া করলে তাদেরকে চন্দ্র দু’টুকরো করে দেখানো হয়। কুরাইশরা এ নিদর্শন দীর্ঘ সময় পর্যন্ত দেখতে থাকে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁরা ঈমান গ্রহণ করেনি। বরং তাঁরা বলে, মুহাম্মাদ আমাদেরকে যাদু করেছে তন্মধ্যে এক ব্যক্তি বললো, আমাদের যাদু করলেও সব মানুষকেও তো আর যাদু করতে পারবে না। দূতের অপেক্ষা কর। বিভিন্ন দূত আসলে জিজ্ঞেস করা হয় এবং তাঁরা বলে হ্যাঁ আমরাও দেখেছি। কিন্তু কুরাইশরা নিজেদের কুফরে জেদ ধরে রয়ে গেলো। চন্দ্র দু’টুকরা হওয়া এক বৃহত্তর অলৌকিক ঘটনার পটভূমি ও অবতরনিকা ছিলো। আর তা হল মেরাজের ঘটনা।


"মেরাজ :


তায়েফ থেকে ফিরে আসা, তাদের রুঢ় ও অমানবিক আচরণ এবং আবু তালিব ও খাদিজার মৃত্যুর পর কুরাইশের অত্যাচার বহু গুণে বৃদ্ধি পায়। এতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্তরে একাধিক চিন্তা একত্রিত হয়। মহান রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে শোকাহত ও দুঃখে কাতর নবীর সান্তনা আসে। নবুওয়াতের ১০ম সালে রজবের ২৭ তারিখের রাতে তিনি যখন নিদ্রারত ছিলেন, জিবরাঈল বুরাক নিয়ে আসেন। বোরাক ঘোড়া সদৃশ এক জন্তু যার দু’টি দ্রুতমান পাখা আছে বিদ্যুতের ন্যায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে তাতে আরোহণ করানো হয় এবং জিবরাঈল তাকে ফিলিস্তীনে বাইতুল মুকাদ্দাসে প্রথমে নিয়ে যান। অতঃপর সেখান থেকে আসামান পর্যন্ত নিয়ে যান। এ ভ্রমনে তিনি পালনকর্তার বড় বড় নিদর্শন পরিদর্শন করেন। আসমানেই পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরজ করা হয়। তিনি একই রাত্রে তুষ্ট মন ও সুদৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে মক্কায় প্রত্যাগমন করেন। ভোর বেলায় কাবা শরিফে গিয়ে তিনি লোকদেরকে একথা শুনালে কাফেরদের মিথ্যার অভিযোগ ও ঠাট্রা বিদ্রুপ আরোপ বেড়ে যায়। উপস্থিত কয়েক জন লোক তাঁকে বাইতুল মুকাদ্দাসের বিবরণ দিতে বলে। মূলত উদ্দেশ্য ছিল তাঁকে অপারগ ও অক্ষম প্রমাণিত করা। তিনি তন্ন তন্ন করে সব কিছু বলতে লাগলেন। কাফেররা এতে ক্ষান্ত না হয়ে বলে, আমরা আর একটি প্রমাণ চাই। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি পথে মক্কাগামী একটি কাফেলার সাক্ষাৎ পাই এবং তিনি কাফেলার বিস্তারিত বিবরণসহ উটের সংখ্যা ও আগমনের সময়ও বলে দিলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সত্যই বলেছেন কিন্তু কাফেররা হটকারিতা, কুফর ও সত্যকে অস্বীকার করার দরুণ ভ্রান্ত রয়ে গেল। সকাল বেলায় জিবরাঈল এসে রাসূলকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পদ্ধতি ও সময়সুচী শিখিয়ে দিলেন। ইতিপূর্বে নামায শুধু সকাল বেলায় দু’রাকআত ও বিকেল বলায় দু’রাকআত ছিলো। কুরাইশরা সত্য অস্বীকার করতে থাকায় এ দিনগুলোতে তিনি মক্কায় আগমণকারী ব্যক্তিদের মাঝে দাওয়াতী তৎপরতা চালাতে লাগলেন। তিনি তাদের অবস্থান স্থলে মিলিত হয়ে দাওয়াত পেশ করতেন এবং তাঁর সুন্দর ব্যাখ্যা দিতেন। আবু লাহাব তাঁর পিছনে তো লেগেই থাকতো। সে লোকদেরকে তাঁর থেকে ও তাঁর দাওয়াত থেকে সতর্ক থাকতে বলতো। এক বার ইয়াসরিব থেকে আগত এক দলকে ইসলামের আহবান জানালে তাঁরা মনোযোগ দিয়ে শুনে এবং তাঁর অনুসরণ ও তাঁর প্রতি ঈমান আনতে ঐক্যবদ্ধ হয়। ইয়াসরিববাসী ইয়াহূদীদের কাছে শুনতো যে অদূর ভবিষ্যতে একনবী প্রেরিত হবেন। তাঁর আবির্ভাবের যুগ নিকটে এসে গেছে।


জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেছিলেন। প্রতিদিন তাঁরা মদিনার বাইরে প্রতীক্ষায় থাকতেন। যে দিন তাঁর আগমন হয় সে দিন সবাই পুলকিত হৃদয়ে তাঁকে সাদর সম্ভাষণ জানান। তিনি মদীনার নিকটে কুবায় যাত্রা বিরতি করেন এবং সেখানে চান দিন অবস্থান করেন। তিনি এ সময় কুবা মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করেন। আর এটাই ইসলামের প্রথম মসজিদ। ৫ম দিন তিনি মদীনার পথে যাত্রা শুরু করেন। অনেক আনসারী সাহাবী রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে অতিথি হিসাবে বরণ করার চেষ্টা করেন এবং তার উটের লাগাম ধরেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের শুকরিয়া আদায় করে বলেন, উট ছেড়ে দাও, সে নির্দেশপ্রাপ্ত। আল্লাহর নির্দেশ যেখানে হল সেখানে গিয়ে উট বসে যায়। তিনি অবতরণ না করতেই উঠে সে অগ্রভাগে কিছু পথ চলে আবার পিছনে এসে প্রথম স্থানে বসে যায়। সেটাই ছিল মসজিদে নব্বীর স্থান। তিনি আবু আইয়্যুব আনসারীর অতিথি হন। আলি ইবন আবু তালিব নবীর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজরতের পর তিন দিন মক্কায় অবস্থান করেন। অতঃপর কুবায় রাসূলের সাথে মিলিত হন।


মসজিদে নব্বীর নির্মাণ :


উট যেখানে বসে গিয়েছিলো জায়গাটি প্রকৃত মালিক থেকে কেনার পর সেখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদ নির্মাণ করেন। একজন মুহাজির ও আনসারী কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেন। ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক গভীর ও সুদৃঢ় হয়। মদীনার ইয়াহুদিদের সাথে কুরাইশদের সম্পর্ক ছিল। তারা মুসলিমদের মাঝে বিশৃংখলা, নৈরাজ্য ও কলহ-বিবাদ সৃষ্টির পায়তারা চালাতো। কুরাইশরা মুসলিমদের নিশ্চিহ্ন করার হুমকিও প্রদর্শন করতো। এ ভাবে বিপদ ও আশংকা মুসলিমদেরকে ভিতর ও বাইরে ঘিরে ছিল। পরিস্থিতি এ পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে যে সাহাবায়ে কেরাম রাতে ঘুমাবার সময় অস্ত্র রাখতেন।


বদরের যুদ্ধ :


এমন বিপদজনক ও বিপদ সংকুল পরিস্থিতিতি আল্লাহ তা‘আলা সশস্ত্র যুদ্ধের অনুমতি দেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম শক্রদের তৎপরতা জানার লক্ষ্যে সামরিক মিশন চালানো আরম্ভ করেন। শক্রদের বানিজ্যিক কাফেলার পিছু নেয়া ও প্রতিরোধ সৃষ্টি করতে লাগলেন, যাতে তারা মুসলিমদের শক্তির কথা উপলদ্ধি করে শান্তি ও সন্ধি প্রক্রিয়ায় এসে ইসলাম প্রচারের স্বাধিনতায় ও তা বাস্তবায়েন কোন ধরনের বিঘ্ন না ঘটায়। কতিপয় গোত্রের সাথে মৈত্রি চুক্তি ও দ্বি-পাক্ষিক চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়। একবার তিনি কুরাইশের এক বানিজ্যিক কাফেলার পথ রুদ্ধ করা কল্পে তিন শত তের জন সাথী নিয়ে বের হন। সাথে ছিল ২টি ঘোড়া ৭০টি উট। আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে কুরাইশী কাফেলায় উট ছিলো ১০০০ এবং ৪০ জন লোক। আবু সুফিয়ান মুসলিমদের বের হবার কথা শুনে জরুরী ভিত্তিতে এক লোক পাঠিয়ে মক্কায় খবর দেয় এবং সাহায্যের আবেদন জানিয়ে রাস্তা পরিবর্তন করে অন্য পথ ধরে। ফলে মুসলিমরা তাদেরকে ধরতে পারেন নি। অন্য দিকে কুরাইশরা এ খবর পেয়ে ১০০০ যোদ্ধা নিয়ে বের হয়ে পড়ে কাফেলার সাহায্যের জন্য। আবু সুফিয়ান কাফেলার নিরাপদে চলে আসার খবর জানিয়ে তাদেরকে মক্কায় ফিরে যাবার অনুরোধ জানায়। কিন্তু আবু জাহেল ফিরে যেতে অস্বীকার করে এবং যোদ্ধারা বদর নামক স্থান পর্যন্ত যাত্রা অব্যাহত রাখে। কুরাইশের বের হবার কথা জেনে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামদের সাথে পরামর্শ করলে সবাই কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার রায় দেন। হিজরী ২য় সনে ১৭ই রমজান শুক্রবার ভোর বেলায় উভয়দল মুখো মুখি হয় এবং তমুল যুদ্ধ চলে। মুসলিমরা বিপুলভাবে জয়লাভ করেন। তাদের মধ্যে ১৪জন শাহাদতের অমীয় সুধা পান করেন। ৭০ জন কাফের নিহত এবং ৭০ জন গ্রেফতার হয়। যুদ্ধকালীন সময়ে নবী কন্যা রুকাইয়্যা মৃত্যুবরণ করেন। ওসমান (রাদিয়াল্লাহু আনহু) রাসূলের নির্দেশে তাঁর রোগাক্রান্ত স্ত্রীর পরিচর্যা ও দেখা-শুনার জন্য মদীনায় থেকে যাওয়ার ফলে বদর যুদ্ধে অংশগ্রহন করতে পারেন নি। যুদ্ধের পরে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর আর এক মেয়ে উম্মে কুলসুমকে ওসমানের সাথে বিয়ে দেন। তাই তাঁর উপাধি ছিল “যিন্নূরাইন” কারণ তিনি রাসূলের দু’কন্যা বিয়ে করেছিলেন। যুদ্ধ শেষে মুসলিমরা আল্লাহর সাহায্যে উল্লাসিত ও আনন্দিত হয়ে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন। সাথে ছিল যুদ্ধ বন্দী ও মালে গনিমত। যুদ্ধ বন্দীদের মধ্যে কিছু লোককে পণ্যের বিনিময়ে, আবার অনেককে এমনিতে মুক্তি দেয়া হয়। তাদের মধ্যে কিছু লোকের মুক্তিপণ ছিলো মুসলিমদের ১০জন ছেলেকে লেখা পড়া শিখিয়ে দেয়া।


ওহুদের যুদ্ধ :


বদর যুদ্ধের পর মুসলিম ও মক্কার কাফেরদের মধ্যে যেসব যুদ্ধ সংঘটিত হয় ওহুদ যুদ্ধ হচ্ছে তন্মধ্যে দ্বিতীয়। এতে মুশরিকরা জয়লাভ করে। কারণ কিছু সংখ্যক মুসলিম রাসূলের নির্দেশ যথাযথভাবে পালন করেন নি। ফলে সুপরিকল্পিত কলা কৌশলকে ব্যাহত করে। যুদ্ধে কাফেরদের সংখ্যা ছিল ৩০০০। পক্ষান্তরে মুসলিম ছিলেন ৭০০ জন।


খন্দকের বা পরিখা যুদ্ধ :


এ যুদ্ধের পর মদীনার কিছু ইয়াহুদী মক্কায় গিয়ে মক্কাবাসীকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার উস্কানি দেয় এবং নিজেদের সমর্থন, সাহায্য সহযোগিতার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে। ফলে কাফেররা ইতবাচক সাড়া দেয়। অতঃপর ইয়াহুদীরা অন্যান্য গোত্র সমুহকে উস্কানি দিলে তারাও মুসলিমদের বিরুদ্ধে লড়ার প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করে। মুশরিকরা প্রত্যেক এলাকা থেকে মদীনা অভিমুখে রওয়ানা দেয়। ১০,০০০ যোদ্ধা সমবেত হল। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম শক্রপক্ষের তৎপরতার কথা জেনে সাহাবীদের সঙ্গে পরামর্শ করেন। সালমান ফারসী মদীনার যে দিকে পাহাড় নেই, সে দিকে পরিখা খননের পরামর্শ দেন। সব মুসলিম উদ্যম ও প্রেরণা সহকারে পরিখা খননে অংশগ্রহণ করেন এবং কাজ সত্ত্বর সমাপ্ত হয়। মুশরিকরা এক মাস পর্যন্ত অবস্থান করেও পরিখা অতিক্রম করতে সক্ষম হয়নি। অবশেষে আল্লাহ তা‘আলা প্রচন্ড বাতাস প্রেরণ করে কাফেরদের তাবু সমূহ উপড়ে ফেলেন । তারা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে এবং শীঘ্রই নিজ নিজ শহরে ফিরে যায়।


মক্ক বিজয় :


হিজরি ৮ম সনে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা অভিযান চালানোর ইচ্ছা করেন। ১০ই রমজান ১০০০০ সদস্যের বাহিনী নিয়ে মক্কাঅভিমুখে রওয়ানা হন। মক্কায় যুদ্ধ ছাড়াই প্রবেশ করেন। কুরাইশরা আত্মসমর্পন করে। আল্লাহ তা‘আলা মুসলিমদেরকে বিজয় দান করেন। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কা‘বা শরীফ তাওয়াফ করে কা‘বার অভ্যন্তরে দু’রাকআত নামায আদায় করেন। অতঃপর ভেতরে রাখা সব মুর্তি চুর্ণ বিচুর্ণ করেন। কা‘বা শরীফের দরজায় দাড়িয়ে মসজিদে হারামে কাতারবদ্ধভাবে অপেক্ষারত সমবেত কুরাইশদেরকে বলেন, হে কুরাইশরা ! তোমাদের সাথে কি আচরণ করবো বলে মনে করো। তাঁরা বলে ভালো আচরণ, দয়াবান ভাই, দয়াবান ভাই এর পুত্র। তিনি বলেন, যাও তোমরা সবাই মুক্ত। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ক্ষমার উজ্জল ও বৃহত্তম দৃষ্টান্ত পেশ করেন। তারাই সেই লোক যারা তাঁর সাহাবাদের উপর চালিয়ে ছিল অত্যাচারের স্ট্রীম রোলার, খুন করেছে অনেককে, কষ্ট দিয়েছে স্বয়ং তাঁকে এবং নিজের মাতৃভুমি থেকে বহিস্কার করেছে। মক্কা বিজয়ের পর লোকজন দলে দলে আল্লাহর দ্বীনের ছায়াতলে সমবেত হয়। হিজরি ১০ম সনে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজ্জ করেন। এটা তাঁর একমাত্র হজ্জ ছিল। তাঁর সাথে এক লাখ লোক হজ্জ করেন। হজ্জ পালন শেষে তিনি মদীনায় প্রত্যাগমন করেন।


মাদানী জীবনঃ


নিজ গোত্র ছেড়ে অন্য গোত্রের সাথে যোগদান আরবে অসম্ভব হিসেবে পরিগণিত হত। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে সেরকম নয়, কারণ এক্ষেত্রে ইসলামের বন্ধনই শ্রেষ্ঠ বন্ধন হিসেবে মুসলিমদের কাছে পরিগণিত হত। এটি তখনকার যুগে একটি বৈপ্লবিক চিন্তার জন্ম দেয়। ইসলামী পঞ্জিকায় হিজরতের বর্ষ থেকে দিন গণনা শুরু হয়। এজন্য ইসলামী পঞ্জিকার বর্ষের শেষে AH উল্লেখিত থাকে যার অর্থ: After Hijra।


স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও সংবিধান প্রণয়ন:


মুহাম্মাদ মদীনায় গিয়েছিলেন একজন মধ্যস্থতাকারী এবং শাসক হিসেবে। তখন বিবদমান দুটি মূল পক্ষ ছিল আওস ও খাযরাজ। তিনি তার দায়িত্ব সুচারুরুপে পালন করেছিলেন। মদীনার সকল গোত্রকে নিয়ে ঐতিহাসিক মদীনা সনদ স্বাক্ষর করেন যা পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম সংবিধান হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকে। এই সনদের মাধ্যমে মুসলিমদের মধ্যে সকল রক্তারক্তি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এমনকি এর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নীতির গোড়াপত্তন করা হয় এবং সকল গোত্রের মধ্যে জবাবদিহিতার অনুভুতি সৃষ্টি করা হয়। আওস, খাযরাজ উভয় গোত্রই ইসলাম গ্রহণ করেছিল। এছাড়াও প্রধানত তিনটি ইহুদী গোত্র (বনু কাইনুকা, বনু কুরাইজা এবং বনু নাদির)। এগুলোসহ মোট আটটি গোত্র এই সনদে স্বাক্ষর করেছিল। এই সনদের মাধ্যমে মদীনা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)হন তার প্রধান।


মক্কার সাথে বিরোধ ও যুদ্ধ:


মদীনায় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরপরই মক্কার সাথে এর সম্পর্ক দিন দিন খারাপ হতে থাকে। মক্কার কুরাইশরা মদীনা রাষ্ট্রের ধ্বংসের জন্য যুদ্ধংদেহী মনোভাব পোষণ করতে থাকে। মুহাম্মাদ(স)মদীনায় এসে আশেপাশের সকল গোত্রের সাথে সন্ধি চুক্তি স্থাপনের মাধ্যমে শান্তি স্থাপনে অগ্রণী ছিলেন। কিন্তু মক্কার কুরাইশরা গৃহত্যাগী সকল মুসলিমদের সম্পত্তি ক্রোক করে। এই অবস্থায় ৬২৪ সালে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)৩০০ সৈন্যের একটি সেনাদলকে মক্কার একটি বাণিজ্যিক কাফেলাকে বাঁধা দেয়ার উদ্দেশ্যে পাঠায়। কারণ উক্ত কাফেলা বাণিজ্যের নাম করে অস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টা করছিল। কুরাইশরা তাদের কাফেলা রক্ষায় সফল হয়। কিন্তু এই প্রচেষ্টার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য যুদ্ধের ডাক দেয়। আত্মরক্ষামূলক এই যুদ্ধে মুসলিমরা সৈন্য সংখ্যার দিক দিয়ে কুরাইশদের এক তৃতীয়াংশ হয়েও বিজয় অর্জন করে। এই যুদ্ধ বদর যুদ্ধ নামে পরিচিত যা ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের ১৫ মার্চ তারিখে সংঘটিত হয়। মুসলিমদের মতে এই যুদ্ধে আল্লাহ মুসলিমদের সহায়তা করেছিলেন। যাহোক, এই সময় থেকেই ইসলামের সশস্ত্র ইতিহাসের সূচনা ঘটে।

Post a Comment

Previous Post Next Post